গল্প- আত্মসাৎ | মুহাম্মদ ওবাইদুল্যাহ্ ফারুক || ctgcampus
গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রচন্ড রোদ আর বৃষ্টি।কালবৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে কৃষাণের ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে,গাছের অনেক কাঁচা পাঁকা আম পড়ে যাচ্ছে।পাড়ার ছেলে মেয়েরা ভোরের মিটি মিটি আলোতে আম কুঁড়াতে বাগানে বাগানে ছুটছে।মুয়াজ্জিন সাহেব ফজর নামাজ শেষ করে মকতবে ছোট ছোট শিশুদের পড়ানোর জন্য অপেক্ষা করছে।কিন্তু বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত সব কিছু বন্ধ।মসজিদ গুলোতে সীমিত মুসল্লিদের উপস্থিত রেখে চালু আছে।তাই মকতবে এখন শিশুরা পড়তে আসে না।তবুও মুয়াজ্জিন সাহেব মসজিদের বারান্দায় বসে থাকেন।
মিন্টু সাহেব আনন্দপুর গ্রামের চেয়ারম্যান।তার একমাত্র বোন জুঁই চৌধুরী আমেরিকাতে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছে।আমেরিকার অবস্থও এখন আর ভালো নেই।প্রতিদিন হাজার খানেক লোক আক্রান্ত হচ্ছে।সেখানে লকডাউন চলছে।প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হওয়া নিষেধ।জুঁইরা বাসা থেকে প্রয়োজন ছাড়া বের হয় না।বাসায় অবস্থান করে দেশের খবরাখবর নিচ্ছে।এলাকার গরীব দুঃখী মানুষের কথা তখন খুব মনে পড়ছে জুঁই চৌধুরীরর।
আফজাল মিয়া মিন্টু সাহেবের এলাকার গরীব বর্গাচাষা।দিনে এনে দিনে খেয়ে সুখী পরিবারে জীবন যাপন করতেছেন।করোনার জন্যে স্কুল বন্ধ হওয়ায় আফজাল মিয়ার একমাত্র ছেলে বজল মিয়া বাবার সাথে মাঠে চাষের কাজে দিন কাটাচ্ছে।আফজাল মিয়া জমির এক অংশে টমেটো আর বেগুনের ক্ষেত করছে।অন্য অংশে মিষ্টি আলু ও মুগ ডালের ক্ষেত করল।আকাশের অবস্থা তত ভাল নয়।খুব বৃষ্টি নামবে।মেঘের আনা ঘোনা দেখা যাচ্ছে।আফজাল মিয়া বেশ চিন্তায় পড়ল।সামনে রমজান মাস আসতেছে।তার মধ্যে ক্ষেতে এখনো অনেক ফসল পড়ে আছে।কাল বৈশাখী ঝড় নামবে যে শিওর।কিন্তু জমির ফসল যে নষ্ট হয়ে যাবে সেই চিন্তায় আল্লাহকে আরো বেশি ডাকতে লাগলেন।
গত শনিবার থেকে রোজা শুরু হয়েছে।তার আগের সোমবার মুশলধারে বৃষ্টি পড়ল।ক্ষেতের অনেক ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।আফজাল মিয়া জমি থেকে পানি সরানোর রাস্তা করে দিলেই দুই দিন পর মোটামোটি জমি থেকে পানি সরে যায়।
করোনা ভাইরাসের কারণে বাজারের অবস্থা মন্দা।রমজানের আগের দিন শুক্রবারে হাট থেকে ক্ষেতের টমেটো,বেগুন আর মিষ্টি আলু সস্তা দামে বিক্রি করে রমজানের জন্য কিছু চনাবুট,মুড়ি কিনলেন।করোনার কারণে জিনিস পত্রের দাম বেড়ে গেছে।আফজাল মিয়ার মত অনেক পরিবারের অভাব শুরু হয়ে গেছে।
চেয়ারম্যান সাহেবের বোন আমেরিকা থেকে এলাকার অসহায় পরিবারের জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন।এ খবর গ্রামের সবার কানে পৌছে যায়।আজকাল মধ্য বিত্ত পরিবার গুলোর সবার কাছে স্মার্ট ফোন আছে।তাই এলাকার অনেকের সাথে মোবাইলে ইমুতে কথা হয় জুঁই চৌধুরীর।জুঁই চৌধুরীর স্কুল সহপাঠী নিজামের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হওয়ায় আনন্দপুর গ্রামের সব খবর জানতে পারে।তাছাড়া নিজাম খুব সামাজিক ও সাহসী একটা তরুণ যুবক।সব কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি গ্রামের মাঝ বরাবর।গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের মানুষজন প্রায়ই মিন্টু সাহেবের উপর নির্ভর।আর পূর্ব প্রান্তের মানুষ গুলো মিন্টু সাহেবের প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার সাহেবের উপর নির্ভর। পশ্চিম প্রান্তের মানুষ জনও আনোয়ার সাহেবের প্রতি অনেক আস্থাশীল।আনোয়ার সাহেব এমনিতেই সবাইকে দান খয়রাত করে সাহায্য করেন।মিন্টু সাহেব তার সহকারী সেক্রেটারিকে পুরো এলাকার অসহায় পরিবারের একটা তালিকা সংগ্রহ করতে বললেন।জুঁই এর বন্ধু নিজামের বাড়ী আনন্দপুর গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে হওয়ায় তাকে পশ্চিম প্রান্তের অসহায় পরিবার গুলোর একটা তালিকা তৈরী করতে বললেন মিন্টু সাহেব।রিজাম দ্রুত তালিকা সংগ্রহ করে দিল।সপ্তাহ খানেক হয়ে গেল।এখনো পশ্চিম প্রান্তের পরিবারে জুঁই চৌধুরী কর্তৃক দেয়া মিন্টু সাহেবের মাধ্যমের কোনো দান পেলো না।নিজামের সাথে আনোয়ার সাহেবের সাথেও ভালো সম্পর্ক আছে।আসলেই আনোয়ার সাহেব মধ্য বিত্তের সচেতন এবং বন্ধু সূলভ বলেই সবার সাথে সম্পর্ক আছে।আনোয়ার সাহেব তার নিজস্ব তহবিল থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করে স্বল্প পরিমাণ হলেও পুরো গ্রামের সকল অসহায়দের মাঝে তিনি নিজে গিয়েই সহযোগিতা করে আসছেন।এদিকে নিজাম জানতে পারল মিন্টু সাহেব গ্রামের পূর্ব প্রান্তে দানের নাম করে সবার কাছে আগামী নির্বাচনের জন্যে ভোট চাচ্ছে।অথচ পশ্চিম প্রান্তের কেউ কোনো দানের অংশই পেল না।নিজাম নিজেই মিন্টু সাহেবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন এবং বললেন চেয়ারম্যান সাহেব,তালিকা নিয়ে গেলেন যে আজ সপ্তাহ খানেক হয়ে গেলো,এখনো তো পশ্চিম প্রান্তের কেউ কোনো দানের অংশ পেল না।মিন্টু সাহেব বললেন,আরে ছোট ভাই নিজাম,আমার বোন জুঁই চৌধুরী যে টাকাটা পাঠালো সেটা আমার জন্যে ত্রিশ হাজার আর পূর্ব প্রান্তের গুটি কয়েকজনের জন্যে বিশ হাজার টাকা পাঠাল।কারণ সামনের নির্বাচনে পূর্ব প্রান্তের লোক গুলারে আমার হাত করা লাগবেই। নিজাম বলল,এইটা কি বললেন চেয়ারম্যান সাহেব?মানুষ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছে,আর আপনি নির্বাচনে জন্যে লোকজন হাত করতেছেন?মিন্টু সাহেব বললেন,আরে ছোট ভাই!তোমারে ঐসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।তুমি বরং একটা কাজ কর,পশ্চিম প্রান্তের অসহায় সবার জন্য আরেকটা তালিকা সংগ্রহ করে কালই আমাকে দাও।সরকারী কোষাগার থেকে ত্রাণ আসছে।তা দিয়েই পুষিয়ে দিব।
নিজাম কাল বিলম্ব না করে বিকালের মধ্যে বসে আরেকটা তালিকা দিয়ে দিল মিন্টু সাহেবকে।নিজাম মনে মনে ভাবল,জুঁইয়ের টাকাটা হয়ত ঘরের লোক বলেই মেরে দিল।কেউ দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করতে পারল না।কিন্তু সরকারে টাকা তো আর মারতে পারবে না।এবার আশা করা যায় সবাই ত্রাণ পাবে।
হাট বাজারের অবস্থা খুবই ভয়াবহ।সব কিছুর দামে আগুন।এদিকে আফজাল সাহেবের ক্ষেতের ফসল প্রায় শেষ।যা আছে তা তেমন বিক্রি করতে পারে না।আনোয়ার সাহেবের দেয়া যে দান পেল তাও এখন শেষ পর্যায়ে।গত দুই দিন পানি খেয়ে ইফতার করছেন।সাহরীতে অভাবের কষ্ট পরিবারের কেউ না বুঝার জন্যে দুই গ্রাস ভাত মুখে নিয়ে সারাদিন কষ্ট চাপিয়ে রোজা রাখছেন।
মিন্টু সাহেবকে তালিকা দেয়ার ছয় দিন পরও কোন ত্রান আসলো না।এদিকে আনোয়ার সাহেবের ক্ষুদ্র প্রচেষটায় দ্বিতীয় বারের মত দান করল গ্রাম বাসীকে।তাও তেমন পোষায় না।আনোয়ার সাহেবও কি করবেন।তিনি তো নিজেই মধ্যবিত্ত পরিবারের।নিজস্ব তহবিলে যা পেরেছেন তাই দিয়েই যাচ্ছেন।
হঠাৎ মিন্টু সাহেবের বাড়িতে তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত লোক এসে মিন্টু সাহেবকে সরকারী ত্রান আত্মসাতের কারণে বিশাল অংকের টাকা জরিমানা করেন এবং আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর হাতে স্পর্ধিত করেন।বাকী ত্রান ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে ইনসাফের ভিত্তিতে বিলিয়ে কাজ চালু করেন।গ্রামের লোকজনে বলাবলি করছে,"গরিবের হক যারা আত্মসাৎ করে,তাদেরকে আল্লাহ ছাড়েন না"।
মাশাআল্লাহ্♥ সুন্দর লিখনি।
ReplyDelete